-->

মনসামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা নারায়ণদেবের কবি প্রতিভা

মনসামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা নারায়ণদেবের কবি প্রতিভা


মধ্যযুগীয় বাংলাসাহিত্যে একটি বড় বৈশিষ্ট্য হল মঙ্গলকাব্য। খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতক থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এই মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে। সমগ্র বাংলাদেশেই এই সকল মঙ্গলকাব্য সমূহের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যাঁদের লেখনীর গুণে মঙ্গলকাব্যগুলি বাংলাসাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে তাঁদের মধ্যে এক এবং অন্যতম হলেন কবি নারায়ণদেব ।

আভাময় অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগের মধ্যে মনসামঙ্গল সাহিত্যের ঊষার আভাস যাঁর লেখনীর স্পর্শে প্রথম প্রস্ফুটিত হয়েছে তিনি কবি নারায়ণদেব। তাঁর রচিত কাব্যের মধ্যে তাঁর আবির্ভাবকাল সম্বন্ধে যথাযথ কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। তিনি তাঁর কাব্যে যে আত্মপরিচয় দিয়েছেন তাতে ময়মনসিংহের বোর গ্রামের অধিবাসী ছিলেন তিনি। তাছাড়া নারায়ণদেবের যে বংশতালিকা পাওয়া গেছে সেখান থেকে পাওয়া যায় বর্তমানে অষ্টাদশ পুরুষ চলছে। সুতরাং চারপুরুষে যদি এক শতাব্দী হয় তাহলে তাঁর আবির্ভাবকাল খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতক হওয়াই যুক্তিযুক্ত। কবি তাঁর পদ্মপুরাণকাব্যে যে আত্মপরিচয় দিয়েছেন তা এইরূপ

পিতামহ উদ্ধব নরসিংহ পিতা

মাতামহ প্রভাকর রুক্মিণী মোর মাতা

নারায়ণদেবের কাব্যের পূর্ণাঙ্গ পুঁথি অবলুপ্ত। তাছাড়া বিভিন্ন গায়েনের হস্তক্ষেপে তাঁর কাব্যের সংক্ষিপ্ত রূপও অনেক পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তবে তাঁর কাব্যে কাহিনীর সংক্ষিপ্ততা এবং বর্ণনার ভঙ্গির আঙ্গিকগত অসংলগ্নতা থাকলেও ভাব কল্পনায় দৃঢ়, নিবদ্ধ সংহতি সুস্পষ্ট। নারায়ণদেবের একটি উপাধি ছিল সুকবিবল্লভকিংবা কবিসার্বভৌম। যে যুগে ধর্মের মনের উপর একাধিপত্য ছিল সেই যুগে বসেই কবি ধর্মের ভিতর থেকে চিরন্তন মানবাত্মার সুখ-দুঃখের সন্ধান করেছেন এবং দ্বিতীয়ত অত্যাচারিত অপরাজিত পরাক্রমের সুস্পষ্ট ছবি একমাত্র তাঁর কাব্যেই প্রতিফলিত হয়েছে।

কাব্যের অন্তিম স্তবকে অন্যান্য কবিগণ যেখানে সমাজ ভক্তির বেদিমূলেই নমনিত পূজারী চাঁদ সদাগরের চিত্রাঙ্কনে মুগ্ধ বিবশ। সেখানে একমাত্র নারায়ণ দেবই চাঁদসদাগরের জ্বলন্ত পৌরুষের ছবি এঁকেছেন। চরিত্র সৃষ্টিতেও কবির দক্ষতা স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল। তাঁর চিত্রিত চাঁদসদাগর চরিত্রের মধ্যে সে ভাবমূৰ্চ্ছনা ঝংকৃত হয়েছে তা হল মনিবের আদিম পৌরুষ। দৈবশক্তির অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদ মূলে প্রতিহিংসা পরায়ণ মানুষের চিরন্তন পৌরুষের প্রতীক রূপে তাঁর চিত্রিত চাঁদসদাগর ক্ষণিক আলোর শাশ্বত শিখায় উদ্ভাসিত হয়েছে।

মহাকাব্যের নায়কের মত সে শোকে উন্মাদ। প্রতিহিংসায় ভয়ঙ্কর। সাথে সংকীর্ণচিত্ত। কিন্তু সর্বত্রই আত্মগোপনে অক্ষম । শুধু চাঁদ সদাগর নয়। বেহুলার চরিত্রাঙ্কনেও নারায়ণদেব কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। কেবল বীরাঙ্গনা সংকল্প এবং আত্মপ্রত্যয়ের পরিচয়ে অদ্বিতীয়া । তাই সাথী হারানোর গোপন বেদনায় তার অন্তরলোক বেদনামথিত হলেও সংকল্প করতে ছাড়ে না। জেদি বেহুলা সাহসের সঙ্গে নিজের পতির জন্যে দেবপুরীতে যেতে প্রস্তুত এবং সেখানে বিষহরীকে জয় করবার উন্মাদনায় সে উন্মুখ।

বেহুলা এখানে চিরন্তন নারীর প্রতিনিধি হিসেবে রেখায়িত । তাছাড়া মনসা, লখিন্দর এবং অন্যান্য চরিত্রও লেখকের রচনা দক্ষতায় আপন আপন মহিমায় ভাস্বর। আসলে মনসামঙ্গল কাব্য মানুষের বেদনাময় অনুভূতির কাব্যসম্মত রূপায়ণ । আর সেই বেদনার করুণ সুর একমাত্র নারায়ণ দেবের কাব্যেই সম্যক ভাবেই প্রকাশিত অন্যান্য কবিদের কাব্যে চাঁদ সদাগরের অবিশ্বাস ও হৃদয়হীনতার জন্য যা অবরুদ্ধ, নারায়ণ দেবের কাব্যে তা বেদনাগত ধারায় উচ্ছ্বসিত। একদিকে সংকল্প বিচ্যুতির হাহাকার, অপরদিকে প্রিয়জন হারানোর সর্বহারার অন্তরে নিঃস্ব আকুতি। আর এই দুইয়ের মাঝে চাঁদসদাগর যেন বনস্পতির মত দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর সাজানো বাগান ধীরে ধীরে শুকিয়ে ফেলে তাঁর বহু সাধের সংসার মনসার কোপে বিপদপুরীতে পরিণত হয়। চারিদিকব্যাপী মহাশূন্যতার মধ্যে যেমন একটি বৃহৎ বনস্পতি তাঁর পাতাবিহীন শাখা প্রশাখাগুলি নিয়ে রৌদ্রজ্বালাকে সহ্য করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে ঠিক তেমনি চাঁদসদাগর তাঁর হৃদয়ের বেদনাকে অনন্তকালের কাছে জিজ্ঞাসা রূপে রেখে দিয়েছে।

ব্যঙ্গবিদ্রূপের মাধ্যমে নারায়ণদেব এ কাব্যের কৌতুক রচনারও প্রকাশ ঘটিয়েছেন। যেমন ডোমনীচণ্ডীর মহাদেবকে ব্যঙ্গ—

“বানরের মুখে যেন ঝুনা নারিকেল,

কাকের মুখেতে যেন দিব্য পাকা বেল।

নারায়ণদেবের এ কাব্যে প্রত্যাবর্তন কাহিনী দৃশ্যমান তা একটি রূপক, ভারতীয় ধর্ম সাহিত্যের আদর্শে বীর বা বীরাঙ্গনার মৃত্যুর পর তাঁর পুনরায় জীবন প্রাপ্তি না দেখালে কাব্য সম্পূর্ণ হয় না। তাই তাদের প্রত্যাবর্তনের বৃত্তান্ত কাব্যের মধ্যে যুক্ত থাকবেই । অবশ্য এক্ষেত্রে বেশীরভাগ কবির রচনায় রূপকের সঙ্গে সত্যের ব্যবধান অবলুপ্ত। কিন্তু নারায়ণদেব সেখানে সফলতা লাভ করেছেন ।


চাঁদসদাগরের পুত্র লখিন্দরের পুনরায় জীবনলাভে চাঁদের মর্মে একটা সংঘাতের আবির্ভাব ঘটেছে। তাই সকলের অনুরোধে চাঁদ যখন মনসার পূজা করবে না বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেন তখন তাঁর মনে ভেসে ওঠে অসহায়া বেহুলার করুণ মুখের ছবি। যা গভীরভাবে চাঁদের মনে দাগ কাটতে আরম্ভ করে। এখানে চাঁদের কাছে বেহুলা তখন আর পুত্রবধূ নয় সে হয়ে উঠেছে ব্যথিত মানবাত্মার প্রতীক আর সেই মানবাত্মার প্রতি সহানুভূতিতে চাঁদ তাঁর আজন্ম পূজিত আদর্শের অটুট নিষ্ঠাকে ত্যাগ করে ব্যথিত মানবাত্মার বেদনাবোধকে স্বীকার করে নিয়েছেন। তবুও শেষপর্যন্ত চাঁদের শাশ্বত পৌরুষের উজ্জ্বল প্রকাশরূপ আবার লক্ষ্য করি

চাঁদবোলে তোমাপারি পূজিবারে।

আমার নাম চান্দোয়ায় টাঙ্গাও তো উপরে।।

বাংলাসাহিত্য যখন কোনরকমে অনুবাদ এবং অনুকরণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে তখন এরকম চরিত্র সন্ধান একটি বিস্ময়কর ব্যাপার। তাছাড়া আরও বিস্ময়কর যেটা তা হল এরূপ চরিত্রকে জীবন্ত ভাবে অঙ্কন করা। যে অঙ্কন দক্ষতায় নারায়ণদেবের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। নারায়ণদেবের কাব্য পৌরাণিক সাহিত্যের পরিবেশ ঘোষিত রুচিনিষ্ঠার ফসল। কাব্যের প্রতি ছত্রে ছত্রে তা ব্যক্ত হয়েছে। পাণ্ডিত্য কবিত্ব প্রকাশের ক্ষেত্রে কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং পাণ্ডিত্য এবং কবিত্বের সহযোগে কবির কাব্যসৃষ্টি হয়েছে উজ্জ্বল। বাংলার ঘর এবং বাহিরকে এমনভাবে একাকার করে নেওয়ার ক্ষমতা পূর্ববর্তী কিংবা পরবর্তী কবিদের মধ্যে দৃষ্ট হয় না । আসলে নারায়ণ দেবের কাব্য রচনা দক্ষতায় ও যোগ্য কবিত্বশক্তির গুণে সার্থক কাব্য হয়ে উঠতে পেরেছে এবং মনসামঙ্গল কাব্যের স্রষ্টা রূপে তাঁর রচিত ‘পদ্মপুরাণ’ শ্রেষ্ঠত্বের দাবী অর্জন করেছে।